
বাংলার আট থেকে আশি – গীতাঞ্জলি নামটা প্রত্যেকের কাছেই চেনা। বুনিয়াদি পাঠ্যপুস্তকের রবীন্দ্রপরিচয়ে লেখা থাকতো – গীতাঞ্জলি অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। বছর দশেক আগে নোবেল প্রাপ্তির ১০০ বছর পার করেছি আমরা। এবং বাংলার নাম ডুবিয়ে আমরা সেটি চুরিও করে ফেলেছি। গীতাঞ্জলি বাংলা এবং বাঙালি জীবনে এক অমোঘ সময়চিহ্ন সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্য, সমাজ, ঔপনিবেশিক রাজনীতি পেরিয়ে সময়ের অসীমতায় চিরন্তন আসন করে নিয়েছে ১৯১৩ সালের এই আশ্চর্য ঘটনা। শতবর্ষ পার করে ফেলেও এ নিয়ে এখনো আলোচনার অবকাশ আছে।
মূলতঃ বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে জন্ম নেওয়া ৮০ পাতার একটি নিন্তাতই ক্ষুদ্রায়তন বই বিশ্বসাহিত্যে আলোড়ন তোলার পথে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, উত্তর দিয়েছে আরো অনেক প্রশ্নের যা এই সময়ে দাঁড়িয়েও ভয়ঙ্কর প্রাসঙ্গিক।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক বিশ্বশিল্পের আঙিনায় বহুদিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য। আধুনিকতার ধারণা সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ইউরোপীয় ‘এনলাইটমেন্ট’ পেরিয়ে এসে শিল্প তখন আবার নতুন মোড় নেওয়ার অপেক্ষায়। ইউরোপীয় প্রগতিশীল শিল্পীরা ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছেন ডাডাইজমের দিকে। যা থেকে খুব শীঘ্রই জন্ম নেবে বহুচর্চিত সাররিয়্যালিজম। বেশ কয়েকবছর আগে ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে ডারউইনের “অরিজিন অব স্পিসিস”। পাশ্চাত্যের মানুষ ঈশ্বরের বদলে অ্যামিবা-কে তাদের পুর্বপুরুষ বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। ১৯০০ সালে প্রকাশিত হলো ফ্রয়েডের “ইন্টারপ্রিটেশান অব ড্রিমস”। ডারউইন সাহেব দৈহিক অস্তিত্বের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিলেন, আর ফ্রয়েড সাহেব দিলে মনোজগতের বিজ্ঞান। তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ জুড়ে ইউরোপীয় শিল্পায়ন এবং ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার ভ্রমাত্মক গর্ব। পাশ্চাত্য সভ্যতা উপনিবেশগুলোর সংস্কৃতিকে মান্যতা দেয়নি কোনদিনই। বরং পাহাড়প্রমাণ অহং নিয়ে নিজেদের সভ্যতার ধারকবাহক ভাবাই তাদের ঐতিহাসিক স্বভাব। এমতাবস্থায় টমাস হার্ডি বা আনাতল ফ্রাঁস-র মতো বাঘা বাঘা পাশ্চাত্য সাহিত্যিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একজন ‘নেটিভ ইন্ডিয়ান’ কবি নোবেল প্রাইজ নিয়ে যাবেন এ বড়ো সহজ কথা নয়।
১৯১২ সালের ৭ই জুলাই লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টের পরিচালক উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের বৈঠকখানায় বসেছে কবিতা পাঠের আসর। রোদেনস্টাইন প্রখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রকর। তদুপরি ভারতবর্ষের শিল্পসংস্কৃতি সম্পর্কে তার অতল আগ্রহ। সে আসরে উপস্থিত ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাহিত্যের দুই খুঁটি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ও এজরা পাউণ্ড। রয়েছেন ডাকসাইটে পরিচিত আরো কিছু সাহিত্যিক ও সমালোচক। পাঠ করা হবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা। রবীন্দ্রনাথ সেবার লণ্ডনে গিয়ে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন রোদেনস্টাইনের বাড়িতে। সদ্য অনুবাদ করা ইংরেজি কবিতাগুলো তিনি নিয়ে গেছিলেন রোদেনস্টাইনের জন্যই। সেই পাণ্ডুলিপি থেকে ইয়েটস সে সন্ধ্যায় পাঠ করলেন কয়েকটি কবিতা। পাঠ শেষ হলে যা ঘটলো তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। সব্বাই উঠে গেলেন একটিও কথা না বলে। নৈঃশব্দে শেষ হল পাঠ।
তারপর তৈরি হল ইতিহাস। ইয়েটস, পাউণ্ড সহ প্রত্যেকেই বাঁধনহীন মুগ্ধতা প্রকাশ করতে শুরু করলেন পরদিন থেকেই। কিছুদিন পরেই আবার আয়োজন হল গীতাঞ্জলি পাঠের। ১০ই জুলাই শ্রোতার সংখ্যা প্রায় একশো ছুঁই ছুঁই। ইংল্যাণ্ডের বুদ্ধিজীবী মহল সামনাসামনি শুনলেন প্রাচ্যের স্বর। কিছুদিনের মধ্যেই রোদেনস্টাইন এবং ইয়েটস এর উদ্যোগে প্রকাশিত হল “Gitanjali: Song Offerings”। অনেকটা রূপকথার গল্পের মতনই পরের বছর নোবেল প্রাপ্তি।

রোদেনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ
বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে ইংরাজি Gitanjali: Song Offerings
রবীন্দ্রনাথের লেখার ইংরেজি অনুবাদের প্রসঙ্গ উঠছিলো বেশ কিছুদিন ধরেই। জগদীশচন্দ্র বসু , অজিত চক্রবর্তী সহ অনেকেই কবিকে ইংরাজি অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বলছিলেন। অল্প কিছু অনুবাদ করতেও শুরু করেছিলেন বেশ কিছু জন। অজিত চক্রবর্তী, রবি দত্ত, বিপিন চন্দ্র পাল, প্রমথলাল সেন, আনন্দ কুমারস্বামী, সিস্টার নিবেদিতা – প্রত্যেকেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গল্প অনুবাদ করেছিলেন ততদিনে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেসব অনুবাদ বিশেষ পছন্দ হয়নি। সময়ের অবধারিত নির্দেশ তখন কবির দিকেই। অথচ কবি নিজে তার ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী নন। ১৯০৯ সালে আমেরিকার আইনবিদ Myron Phelps-কে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –
“…as I have never been used to express myself in the English language I shall not be able to give an adequate or effective idea of what I feel to be the truth about our country”
আমরা মহাকবির এ উক্তিকে বিনয় হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত। তবে কথাটা গীতাঞ্জলি সম্পর্কে কতোটা সত্যি হয়ে উঠতে পারে তা তখনো অকল্পনীয়।
এর মধ্যে ১৯১১ সালের জানুয়ারি রোদেনস্টাইন এলেন কোলকাতায়। অবন ঠাকুরের আমন্ত্রণে। যেন নিয়তির মতোই আলাপ হল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। যদিও রোদেনস্টাইনের আগ্রহ বাংলার ছবি নিয়ে, তিনি মুগ্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বে। তার হাতে পড়ে গেল রামানন্দ চ্যাটার্জী সম্পাদিত Modern Review পত্রিকার জানুয়ারি সংখ্যাটি। তাতে দেবেন্দ্র নাথ মিত্র অনুদিত ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি পড়লেন রোদেনস্টাইন। পড়লেন অজিত চক্রবর্তীর অনুবাদে কিছু কবিতাও। ফেব্রুয়ারিতে লণ্ডন ফিরে যাবার আগে কবিকে সবিশেষ জানিয়ে গেলেন আরো অনুবাদের আর্জি।
১৯১২ সালে মার্চ মাসে রবীন্দ্রনাথের বিলেত যাত্রা পুর্বপরিকল্পিত ছিলো। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারনে সে যাত্রা স্থগিত রাখতে হয়। মাদ্রাজ থেকে ফিরে আসেন তিনি। এসে খানিক সুস্থ হয়েই শিলাইদহে যান। গীতাঞ্জলির অনুবাদের সূচনা এখান থেকেই। ১৯১৩ সালের ইন্দিরা দেবীকে লেখা একটি চিঠিতে এ প্রসঙ্গ দেখতে পাই –
“গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জমার কথা লিখেছিস। ওটা যে কেমন করে লিখলুম এবং কেমন করে লোকের এত ভাল লেগে গেল, সে কথা আমি আজ পর্যন্ত ভেবেই পেলুম না। আমি যে ইংরেজি লিখতে পারিনে এ কথাটা এমনি সাদা যে এ সম্বন্ধে লজ্জা করবার মত অভিমানটুকুও আমার কোনো দিন ছিল না। যদি আমাকে কেউ চা খাবার নিমন্ত্রণ করে ইংরেজিতে চিঠি লিখত তাহলে তার জবাব দিতে আমার ভরসা হত না। তুই ভাবছিস আজকে বুঝি আমার সে মায়া কেটে গেছে- একেবারেই তা নয়- ইংরেজিতে লিখেছি এইটেই আমার মায়া বলে মনে হয়। গেলবারে যখন জাহাজে চড়বার দিনে মাথা ঘুরে পড়লুম, বিদায় নেবার বিষম তাড়ায় যাত্রা বন্ধ হয়ে গেল, তখন শিলাইদহে বিশ্রাম করতে গেলুম। কিন্তু মস্তিষ্ক ষোলো আনা সবল না থাকলে একেবারে বিশ্রাম করবার মত জোর পাওয়া যায় না, তাই অগত্যা মনটাকে শান্ত রাখবার জন্যে একটা অনাবশ্যক কাজ হাতে নেওয়া গেল। তখন চৈত্রমাসে আমের বোলের গন্ধে আকাশে আর কোথাও ফাঁক ছিল না এবং পাখীর ডাকা- ডাকিতে দিনের বেলাকার সকল কটা প্রহর একেবারে মাতিয়ে রেখেছিল। ছোট ছেলে যখন তাজা থাকে তখন মার কথা ভুলেই থাকে যখন কাহিল হয়ে পড়ে তখনি মায়ের কোলটি জুড়ে বসতে চায়- আমার সেই দশা হল। আমি আমার সমস্ত মন দিয়ে আমার সমস্ত ছুটি দিয়ে চৈত্রমাসটিকে যেন জুড়ে বসলুম- তার আলো তার হাওয়া তার গন্ধ তার গান একটুও আমার কাছে বাদ পড়ল না। কিন্তু এমন অবস্থায় চুপ করে থাকা যায় না- হাড়ে যখন হাওয়া লাগে তখন বেজে উঠতে চায়, ওটা আমার চিরকেলে অভ্যাস, জানিস ত। অথচ কোমর বেঁধে কিছু লেখবার মত বল আমার ছিল না। সেই জন্যে ঐ গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি নিয়ে একটি একটি করে ইংরেজিতে তর্জমা করতে বসে গেলুম। যদি বলিস কাহিল শরীরে এমনতর দুঃসাহসের কথা মনে জন্মায় কেন- কিন্তু আমি বাহাদুরি করবার দুরাশায় এ কাজে লাগি নি। আর একদিন যে ভাবের হাওয়ায় মনের মধ্যে রসের উৎসব জেগে উঠেছিল সেইটিকে আর একবার আর এক ভাষার ভিতর দিয়ে মনের মধ্যে উদ্ভাবিত করে নেবার জন্যে কেমন একটা তাগিদ এল। একটি ছোট্ট খাতা ভরে এল। এইটি পকেটে করে নিয়ে জাহাজে চড়লুম। পকেটে করে নেবার মানে হচ্চে এই যে, ভাবলুম সমুদ্রের মধ্যে মনটি যখন উসখুস করে উঠবে তখন ডেক চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার একটি দুটি করে তর্জমা করতে বসব। ঘটলও তাই। এক খাতা ছাপিয়ে আর এক খাতায় পৌঁছন গেল। রোদেনস্টাইন আমার কবিযশের আভাস পূর্বেই আর একজন ভারতবর্ষীয়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তিনি যখন কথা প্রসঙ্গে আমার কবিতার নমুনা পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, আমি কুণ্ঠিতমনে তাঁর হাতে আমার খাতাটি সমর্পণ করলুম। তিনি যে অভিমত প্রকাশ করলেন সেটা আমি বিশ্বাস করতে পারলুম না। তখন তিনি কবি য়েটসের কাছে আমার খাতা পাঠিয়ে দিলেন- তারপরে কি হল সে ইতিহাস তোদের জানা আছে। আমার কৈফিয়ৎ থেকে এটুকু বুঝতে পারবি আমার কোনো অপরাধ ছিল না- অনেকটা ঘটনাচক্রে হয়ে পড়েছে।”
চিঠিটিতে দুটি শব্দবন্ধ লক্ষ্যনীয়। গীতাঞ্জলির অনুবাদ এবং নোবেল প্রাইজ সম্পর্কে তিনি যে শব্দবন্ধ ব্যবহার করছেন – “অনাবশ্যক কাজ হাতে নেওয়া গেল” এবং “আমার কোন অপরাধ ছিল না – অনেকটা ঘটনাচক্রে হয়ে পড়েছে”।
এ তথ্য কারো অজানা নয় যে রবীন্দ্রনাথ সম্পুর্ণ ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ ইংরাজিতে অনুবাদ করেন নি। মূল গীতাঞ্জলি থেকে ৫৩ টি কবিতা বা গান নিয়েছিলেন তিনি। ইংরাজি Gitanjali: Song Offerings-এর ১০৩ টি রচনার বাকিগুলো ‘নৈবেদ্য’, ‘গীতিমাল্য’, ‘খেয়া’ ইত্যাদি আরো বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। তার চেয়েও বড়ো বিষয় Song Offerings মুক্ত গদ্যছন্দে লেখা। ফলতঃ বাংলায় আমরা গীতাঞ্জলি কে যেভাবে গান হিসেবে শুনে এসেছি চিরকাল, ইংরাজি অনুবাদটিতে তা সাধারণতঃ সম্ভব নয়। এ নিয়ে বহুল চর্চা হয়েছে। ইংরাজি অনুবাদে গীতাঞ্জলি তার সুর হারিয়েছে। প্রচলিত বোধে একে অঙ্গহানি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আসলে মুশকিলটা হয় Song Offerings কে গীতাঞ্জলির অনুবাদ হিসেবে দেখতে গিয়ে। অনুবাদ সম্পর্কে আমাদের চিরাচরিত ধারণায় এ কাজকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তার চেয়ে সহজ হয় যদি Song Offerings কে একটি স্বতন্ত্র বই হিসেবে দেখা যায়। প্রত্যেক সার্থক অনুবাদই বোধহয় তাই – একটি স্বতন্ত্র নতুন সৃষ্টি। যদিও বাংলা গীতাঞ্জলির মূল ভাবটি ইংরেজিতে দিব্য সঞ্চারিত হয়েছে। এবং নোবেল প্রাপ্তিতে সেটুকুই আকর। তবু যে প্রশ্নগুলো আবশ্যিকভাবে তৈরি হয় – ব্রিটিশ রাজত্বের একজন ঔপনিবেশিক কবির প্রথম ইংরাজি বই প্রকাশ হলো ১৯১২ তে। ইংরেজ সাহিত্যিকরা, বিশেষ করে ইয়েটস এবং পাউন্ড মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভূয়সী প্রশংসা করলেন। ১৯১৩ তে নোবেল প্রাইজ এল। আর তারপরেই ইয়েটস এবং পাউন্ড দুজনেই অশ্লীলভাবে বিরোধিতা করতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথের। কেন? রবীন্দ্রনাথকেই বা কেন বলতে হলো – “আমার কোন অপরাধ ছিল না – অনেকটা ঘটনাচক্রে হয়ে পড়েছে”?
গীতাঞ্জলির প্রেক্ষাপট
গীতাঞ্জলি রচনা এবং অনুবাদের প্রেক্ষাপটে অনেকগুলো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সম্পর্ক পর্যন্ত বিস্তৃত।
প্রথমতঃ রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনে এমন ঘোরতর সময় বোধহয় আর আসেনি। ১৮৯৯ সালে কবি হারিয়েছেন প্রিয় ভাইপো বলেন্দ্রনাথকে। তারপর একে একে ১৯০১-এ ভাইপো নীতিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০২-এ স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, ১৯০৩-এ মেজমেয়ে রেনুকা, ১৯০৫-এ পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে হারালেন। তারপর কঠোরতম আঘাত বোধহয় ১৯০৭-এ কনিষ্ঠ পুত্র প্রাণপ্রিয় শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু। এমন পরপর স্বজনপ্রয়াণ একজন মানুষকে কীভাবে ভেঙেচুরে দিতে পারে তা অনুমান করাও অকল্পনীয়। তবে মানুষটি যদি রবীন্দ্রনাথ হন তবে বোধহয় ফিনিক্স পাখির মতোই আগুনের স্পর্শে নবজন্ম ঘটে। প্রবল মানসিক ভাঙাচোরার মধ্যেই যদি সে সময় তার সাহিত্যকর্মের দিকে তাকাই অবাক হতে হয়। এর মধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে ‘চোখের বালি’ (১৯০৩) এবং ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬)। ১৯০৭ থেকে ১৯১০ এর মধ্যে প্রবাসীতে নিয়মিত লিখছেন ‘গোরা’। ১৯১০-এ ‘রাজা’ নাটক, ১৯১১ তে ‘ডাকঘর’। ‘খেয়া’, ‘গীতালি’, ‘গীতিমাল্য’ রয়েছে কাব্যগ্রন্থের তালিকায়। এছাড়াও রয়েছে প্রবন্ধ। ব্যক্তিগত শোকের উর্ধে উঠে কর্মের জয়গান গাওয়ার এই অপরিসীম শক্তিই বোধহয় গীতাঞ্জলির মূল শিকড়।
মীরা দেবীকে লেখা চিঠিতে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু প্রসঙ্গে উঠে আসে রবীন্দ্রনাথের জীবনচেতনার সংশ্লেষ –
“যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে । শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি – সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে। সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল । যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। যা ঘটেচে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে।”
এই মানুষটিই অবশ্য কৌশোরে লিখে ফেলেছেন – “মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামসমান”। প্রৌঢ়ত্বের দরজায় এসে সেই সত্য কবি সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করলেন আবার। মৃত্যুর হাত ধরে জীবনের এই বৈদান্তিক প্রশান্তি গীতাঞ্জলির আলম্বনবিভাব। এ জিনিস আমরাই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আত্মীকরণ করতে পারিনি। পাশ্চাত্য বস্তুবাদ কোন মায়ায় চিনলো একে? আমরা উত্তরঔপনিবেশিক সময়ে আজও হয়তো মনে মনে ধারণ করি পাশ্চাত্যের মানসিক উৎকৃষ্টতা। তাই ধরেই নিই আমরা বুঝি নে, বোঝে ওরাই। তাই অরা চিনসে, আমরা চিনি নাই।
পাশাপাশি সে সময়ে ভারতে ব্রিটিশ রাজের অবস্থাও বিশেষ লক্ষ্যনীয়। ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ভারতবর্ষ নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে শুরু করে। ১৮৭৬ সালে রানী ভিক্টোরিয়া শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। স্বরাজচেতনার উন্মেষের পর্ব সে সময়। এই সময়েই ১৯০৫-এ আসে বঙ্গভঙ্গের ধাক্কা। লর্ড কার্জন ভারতবর্ষে ধর্মীয় বিভাজনের বিষবৃক্ষের বীজ রোপন করলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সে বীজ জল পেলো না একেবারেই। প্রতিরোধের মূল খুঁটি হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। কালিদাসের ভাবশিষ্য রবীন্দ্রনাথ রাখিবন্ধন কে মৈত্রীবন্ধনের প্রতীক করে বেঁধে ফেললেন দুই বাংলাকে। ১৯০৫ থেকে ১৯০১০ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ব্রিটিশ রাজত্বকে মহাবিদ্রোহের চেয়ে কিছু কম নাড়া দেয় নি। ১৯১১-তে পঞ্চম জর্জ এলেন ভারতবর্ষে তার অভিষেক যাত্রায়। দিল্লি দরবারে তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষনা করলেন। এক – বঙ্গভঙ্গ রদ, দুই – রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লি স্থানান্তর। ততদিনে বাংলার দুর্জয় মনোভাব এবং বাংলার মুখ রবীন্দ্রনাথকে ইংল্যাণ্ড চিনে নিয়েছে নিশ্চই।
পঞ্চম জর্জ ভারতে আসার পরের বছর ১৯১২-তে গীতাঞ্জলির ইংরেজি পাণ্ডুলিপি নিয়ে ইংল্যাণ্ড যাত্রা করলেন রবীন্দ্রনাথ। ততদিনে বাংলার কাছে ১৮৫৭ এবং ১৯০৫-এর দুই গোলে পিছিয়ে আছে ইংল্যাণ্ড। এবং দুটি গোলই নিজেদের ভুল থেকে তৈরি।

উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস। ১৯০৩। ফোটোগ্রাফার – Alice Broughton
উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস এবং রবীন্দ্রনাথ
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পুর্বদিকে প্রায় বাংলার আয়তনেরই দ্বীপ আয়ারল্যান্ড। ভারতের মতোই আয়ারল্যান্ডও সে সময় ব্রিটিশ কলোনি। ইয়েটসও রবীন্দ্রনাথের মতোই ঔপনিবেশিক কবি। তার লেখার মধ্যে তাই আইরিশ সুর জেগে থাকে প্রতিনিয়ত। ১৯১২-র ২৭শে জুন দেখা হয় ইয়েটস ও রবীন্দ্রনাথের, রোদেনস্টাইনের বাড়িতে। তারপর জুলাই মাসের দুটি বৈঠকে ইয়েটস ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রধান প্রচারক। ইয়েটস এর মুগ্ধতা কী পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা বোঝা যায় Song Offerings বইটিতে ইয়েটস এর লেখা ভুমিকায় –
“I have carried the manuscript of these translations about with me for days, reading it in railway trains, or on the top of omnibuses and in restaurants, and I have often had to close it lest some stranger would see how much it moved me. These lyrics— which are in the original, my Indians tell me, full of subtlety of rhythm, of untranslatable delicacies of colour, of metrical invention—display in their thought a world I have dreamed of all my live long. The work of a supreme culture, they yet appear as much the growth of the common soil as the grass and the rushes. A tradition, where poetry and religion are the same thing, has passed through the centuries, gathering from learned and unlearned metaphor and emotion, and carried back again to the multitude the thought of the scholar and of the noble.”
১০ই জুলাই স্থির হয় অনুবাদগুলি বই হিসেবে প্রকাশিত হবে। ইয়েটস সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। সে বছরই নভেম্বরে ৮০ পৃষ্ঠার বই আকারে প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে। কয়েকমাস পরেই ১৯১৩-র মার্চে প্রখ্যাত প্রকাশক ম্যাকমিলান বাণিজ্যিকভাবে বইটি প্রকাশ করে। এবং এও মূলতঃ ইয়েটস এর উদ্যোগে। পাশ্চাত্য শিল্পমহলে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় (?) পরিচয় ঘটে ইয়েটস-এর সাহচর্যে। সে সাহচর্য এতটাই জোরালো হয়ে পড়েছিলো ইয়েটস গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপিতে ইচ্ছেমত পরিবর্তন করতে দ্বিধা করেননি। রবীন্দ্রনাথও তার ইংরেজি ভাষার প্রতি স্বাভাবিক সংকোচ থেকে বাধা দেন নি। ঘটনাক্রম ঘটছিলোও অত্যন্ত দ্রুত। তবে ইয়েটস-এর এই সম্পাদকীয় পরিবর্তন ঠিক কতোদূর গিয়ে ঠেকেছিলো তার একটা উদাহরণ পাওয়া যায় ম্যাকমিলান প্রকাশিত বইটির ৭৬ নম্বর কবিতায়।

৭৬ নম্বর কবিতার পান্ডুলিপি

ম্যাকমিলান প্রকাশিত ১৯১৩ সংস্করণে কবিতাটির মুদ্রিত রূপ
“Day after day, O lord of my life, shall
I stand before thee face to face ? With
folded hands, O lord of all worlds, shall
I stand before thee face to face ?
Under thy great sky in solitude and
silence, with humble heart shall I stand
before thee face to face ?
In this laborious world of thine,
tumultuous with toil and with struggle,
among hurrying crowds shall I stand
before thee face to face ?
And when my work shall be done in
this world, O King of kings, alone and
speechless shall I Stand before thee
face to face ?“
লাল রঙে চিহ্নিত অংশগুলি ইয়েটস-এর পরিবর্তন। ‘Oh’ থেকে ‘O’ হয়তো তেমন কিছু নয়। workaday ইয়েটস এর পরিবর্তনে হল laborious, surging হল tumultuous, bustling হল hurrying। এই পর্যন্ত হয়তো তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়াও যায়। তবে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত শব্দ বদলে ফেলা খুব একটা অবশ্য প্রয়োজনীয় বোধ হয় না। ইয়েটস সম্পুর্ণ ভুল করেছেন জিজ্ঞাসা চিহ্নগুলি দিয়ে। হয়তো বাক্যের গঠনে shall I জাতীয় ব্যবহারে তিনি কার্যত ধরে নিয়েছেন এগুলো প্রশ্নবোধক বাক্য। প্রশ্ন হল আইরিশ মহাকবি কি প্রশ্নচিহ্নের বদলে shall I -এর ক্রিয়াপ্রধাণ প্রকাশ আদপেই বুঝতে পারলেন না? নাকি রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজিতে অতটা দক্ষ বলে মনেই করলেন না? অথচ বাংলা কবিতাটি মিলিয়ে খেয়াল করে দেখুন –
“প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী,
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর, হে ভুবনেশ্বর,
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
তোমার অপার আকাশের তলে
বিজনে বিরলে হে–
নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
তোমার বিচিত্র এ ভবসংসারে
কর্মপারাবারপারে হে,
নিখিলজগৎজনের মাঝারে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
তোমার এ ভবে মোর কাজ যবে
সমাপন হবে হে,
ওগো রাজরাজ, একাকী নীরবে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।”
প্রশ্নচিহ্নের ফলে সমুখে দাঁড়াবার এমন একটা দৃঢ় বিশ্বাস যে সংশয়ে পরিণত হয়ে গেল তাও বুঝলেন না? এমন সম্পাদনা ইয়েটস সারা পাণ্ডুলিপি জুড়েই করেছেন। হয়তো এ জন্যই এক বছরের মধ্যেই Valentine Chirol নামে The Times-এর এক সাংবাদিক বলেই ফেললেন – “the English Gitanjali was practically a product of Yeats”।
আরো আশ্চর্য লাগে যখন ১৯১৭ সালে ইংরাজি গীতাঞ্জলি ম্যাকমিলান কে লেখা খোদ ইয়েটস-এর একটা চিঠিতে দেখি তার মুগ্ধতাবোধ কেটে গিয়েছে। এ যেন অন্য ইয়েটস –
“You probably do not know how great my revisions have been in the past. William Rothenstein will tell you how much I did for Gitanjali and even his Ms. of The Gardener. Of course all one wanted to do ‘was to bring out the author’s meaning’, but that meant a continual revision of vocabulary and even more of cadence. Tagore’s English was a foreigner’s English and as he wrote to me, he ‘could never tell the words that had lost their souls or the words that had not yet got their souls’ from the rest. I left out sentence after sentence and probably putting one day with another spent some weeks on the task. It was a delight and I did not grudge the time, and at my request Tagore has made no acknowledgement. I knew that if he did so, his Indian enemies would exaggerate what I did beyond all justice and use it to attack him.”
সময় আরো একটু এগোলে দেখবো ১৯৩৫ এ রোদেনস্টাইনকে লেখা একটি চিঠিতে ইয়েটস-এর ভাব এবং ভাষা আরো বদলে যাচ্ছে। চিঠিটি শুরু হচ্ছে এভাবে –
“Damn Tagore. We got out three good books, Sturge Moore and I, and then, because he thought it more important to see and know English than to be a great poet, he brought out sentimental rubbish and wrecked his reputation. Tagore does not know English, no Indian knows English.”
নোবেল কমিটির অভিভাষণ
১৯১৩ সালের ডিসেম্বরে সুইডিশ নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান যে অভিভাষণটি পাঠ করলেন সেটি শুরু হচ্ছে এভাবে –
“In awarding the Nobel Prize in Literature to the Anglo-Indian poet, Rabindranath Tagore,…”
অর্থাৎ নোবল কমিটি রবীন্দ্রনাথকে কেবল ইন্ডিয়ান বললে না, বললে Anglo-Indian poet। তারা আরো বললেন –
“Quite independently of any knowledge of his Bengali poetry, irrespective, too, of differences of religious faiths, literary schools, or party aims, Tagore has been hailed from various quarters as a new and admirable master of that poetic art which has been a never-failing concomitant of the expansion of British civilization ever since the days of Queen Elizabeth.”
অর্থাৎ কিনা – “রবীন্দ্রনাথ তার বাংলা কবিতার নূন্যতম জ্ঞান ব্যতিরেকে, এমনকি ধর্মবিশ্বাস, সাহিত্যধারার বিভিন্ন পার্থক্যের মধ্যে দিয়েও যেভাবে (ইংরাজি) কবিতাশিল্পের প্রণম্য শিল্পী হয়ে উঠলেন তা আসলে ব্রিটিশ সভ্যতার অনুষঙ্গ ছাড়া কিছু নয়। নোবেল কমিটির বক্তব্যে বারবার এসেছে ‘Christian Mission’, ‘Christian Religion’ এবং ‘Christian Faith’ শব্দবন্ধগুলো। যেমন ইয়েটস-এর ভুমিকায় উঠে এসেছে চার্চের প্রসঙ্গ।
ইয়েটস যে ভুলটি করেছিলেন সেটি সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথকে সাধুসন্ত ভেবে নিয়ে। যেমন তিনি গীতাঞ্জলির ভুমিকায় ভারতবর্ষের ঐতিহ্য বুঝেছিলেন – poetry and religion are the same thing। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ধর্মীয় কবি হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। ইয়েটস নিজে আয়ারল্যাণ্ডের ব্রিটিশ কলোনির প্রজা এবং আইরিশ জাতীয়তাবাদে গর্বিত। রবীন্দ্রনাথের স্বর খুব সম্ভবতঃ তার নিজের জাতীয়বাদকে ব্যক্তিগত এবং সাংগঠনিক দুই স্তরেই মজবুত করেছিলো। ইয়েটস-এর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদের এক বলিষ্ঠ স্বর যা ইংল্যাণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হলে সে তার নিজেরও একপ্রকার জয়। এবং হয়তো এ প্রণোদনাই ইয়েটসকে অমন বালখিল্যতায় লাফিয়ে উঠে আদর করে নোবেল জয়ের পর “ড্যাম টেগোর”-এ পৌঁছে দেয়।
কিন্তু নোবেল কমিটির অভিভাষণটি আরো একধাপ এগিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চায় রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সভ্যতারই ফসল। পাশ্চাত্য সভ্যতাই ‘প্রিমিটিভ ইন্ডিয়া’ থেকে একজন রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছে। এ সংবাদ ইংল্যান্ড রাজতন্ত্রের কাছে যেমন আত্মশ্লাঘার তেমনই বঙ্গভঙ্গ রদের প্রধান কারিগরকে নিজেদের দলের লোক প্রমাণ করতে পারলে যে ঔপনিবেশিক সুবিধে পাওয়া যায় তা নেহাত কম নয়। না হলে সাহিত্যে নোবেল প্রসঙ্গে অর্ধশতাব্দী পরে সিপাহী বিদ্রোহের কথা উঠে আসে কী করে। নোবেল কমিটির বক্তব্যের পরের অংশে দেখি –
“It was in Bengal, the oldest Anglo-Indian province and the scene many years before of the indefatigable labours of that missionary pioneer, Carey, to promote the Christian religion and to improve the vernacular language, that Rabindranath Tagore was born in 1861. He was a scion of a respected family that had already given evidence of intellectual ability in many areas. The surroundings in which the boy and young man grew up were in no sense primitive or calculated to hem in his conceptions of the world and of life. On the contrary, in his home there prevailed, along with a highly cultivated appreciation of art, a profound reverence for the inquiring spirit and wisdom of the forefathers of the race, whose texts were used for family devotional worship. Around him, too, there was then coming into being a new literary spirit that consciously sought to reach forth to the people and to make itself acquainted with their life needs. This new spirit gained in force as reforms ere firmly effected by the Government, after the quelling of the widespread, confused Indian Mutiny.”

গীতাঞ্জলি – ইণ্ডিয়া সোসাইটি সংস্করণ (১৯১২)

গীতাঞ্জলি – ম্যাকমিলান সংস্করণ (১৯১৩)
শেষ কথা
এতকিছুর মধ্যে যে কথাটা মর্মন্তুদ সত্যি তা হল Song Offerings-এর মত আর কিছু পাশ্চাত্য আগে কখনো দেখেনি। ফলতঃ পুবের রবির আলোকছটায় ইয়েটস, এজরা পাউন্ড বা মে সিনক্লেয়ার দের মত ইংল্যান্ডের প্রথম সারির এলিট লেখকদের চোখ ধাঁধিয়ে গেছিলো প্রথম দর্শনে। রবীন্দ্রনাথে তারা ভারতীয় যাদু পেয়েছেন এবং সম্মোহিত হয়েছেন। কিন্তু বড়ো একটা বুঝেছেন বলে মনে হয় না। Song Offerings-এ রবীন্দ্রনাথের ইংরাজি ভাষার সাবলীল আধুনিকতাই ধরতে পারেনি পাশ্চাত্য সাহিত্যসমাজ। আর দর্শনসঞ্জাত যে প্রজ্ঞা গীতাঞ্জলির ছত্রে ছত্রে, যার একটিই হয়তো একজন মানুষের সারাজীবনের পাথেয় হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে, যে বৈচিত্র তার ভাবের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চলনে, তার শিকড় বাংলার মাটিতে শতাব্দীপ্রাচীন। তাকে খ্রিষ্টীয় ধর্মের মোড়কে ফেলে বোঝা যায় না। রবীন্দ্রনাথ যেমন কুণ্ঠিত ছিলেন ইংরাজির প্রয়োগে, তেমনই যদি পাশ্চাত্যসমাজ কুণ্ঠিত হতে শিখতো তার ‘সাবঅল্টার্ন’ প্রজাদের সংস্কৃতি নিয়ে তাদের বিপুল অজ্ঞতায়, তাহলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ কিছু বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতেন। আরো ভালো করে বললে ইতিহাসের কতগুলো নির্মম ভুল শুধরে যেতে পারতো।
আর রইলো বাকি গানের কথা। গীতাঞ্জলি আমরা গানেই শুনেছি। গানেই শুনবো। Song Offerings পাশ্চাত্য সুরে আদৌ শুনতে পাবো কিনা জানি নে।
এই পাতাটির পাঠসংখ্যা
N/A
Share on facebook
Share on Facebook
Share on whatsapp
Share on Whatsapp
Share on email
Share on Email
অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। গীতাঞ্জলি নিয়ে এইভাবে ভেবে দেখিনি কখনো। সত্যি বলতে কি ইংরেজি লেখাগুলো পড়িনি আগে। আরো কয়েকটা ইংরেজি ও বাংলা লেখা পাশাপাশি দেখতে পেলে ভালো হতো।
কতো কিছু জানা গেলো..