
শ্রী বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(১৯২০-১৯৮৫)
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বদেশের কবি। গভীর স্বপ্নভঙ্গের প্রকাণ্ড ক্ষোভ ও ব্যঙ্গেই তাঁর কবিতা। ১৯২০ থেকে ১৯৮৫-র পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে শেষপর্বের দুটিমাত্র কবিতা বহু অনুরোধে বড় কাগজে ছাপার অনুমতি দিয়েছিলেন। তিনি ছোট কাগজের কবি। লিটল ম্যাগাজিনের একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থাগারের নাম কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কবিতার উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ সরলতায় অনেকসময় ঢাকা পড়ে গেছে ছন্দের অন্তর্লীন অসাধারণ প্রবাহ ও নৈপুণ্য।
বিক্রমপুরের জাতক কবি বীরেন্দ্র কৈশোরে ও যৌবনে যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী অনুশীলন দলের সঙ্গে। পরবর্তীকালে বামপন্থী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন কিন্তু সরেও আসেন। কারন কবিতার মতই তাঁর চরিত্রেও কোন দ্বিচারিতা ছিলো না। তাই সমসাময়িক নীরেন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘উলঙ্গ রাজা’-র অবস্থা বদলে তাঁর লেখা ‘নীরেন, তোমার ন্যাংটো রাজা’ বুঝিয়ে দেয় বীরেন্দ্র অপ্রাতিষ্ঠানিক। কোন পুরস্কার বা প্রলোভনের শৃঙ্খলে তিনি বাঁধা পড়তে নারাজ। কবিতাকেও কোন ধরনের শেকলে বাঁধার প্রবণতা তাঁর ছিলো না। আঙ্গিকের বিপুল বৈচিত্র – দীর্ঘ পয়ার থেকে মাত্রাবৃত্ত সমস্ত ধরনের ছন্দ, প্রয়োজনীয় আকস্মিক অন্ত্যমিলের জাদু আমরা প্রায়ই তাঁর কবিতায় পাই। ‘অথ মন্ত্রী কথা’-র মত তীব্র ব্যঙ্গ কবিতায় ব্যবহার করেছেন ছড়ার ছন্দ। আবার ‘পিকাসোর জন্য’ কবিতায় দেখি দীর্ঘপয়ারের অপূর্ব বৈচিত্র। সার্থক কবিদের মত বীরেন্দ্রও নিজে কবিতার মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়েন, পাঠক-শ্রোতাদেরও অনায়াসে ডেকে নেন ভিতরে। তীব্র আবেদক তাঁর কবিতাগুচ্ছে আবেগের প্রতিস্পর্ধী উচ্চতা দেখি আমরা।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের নির্মম রাজনৈতিক খেলায় ‘স্বদেশ’ বিস্রস্ত হলে ‘মা’-এর মুখ থুবড়ে পড়া মনে পড়ে তাঁর। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জেলে তেষট্টি দিন অনশনে প্রাণত্যাগ করা যতীন দাস বা মাত্র উনিশ বছরে ফাঁসিতে আত্মত্যাগ করা ক্ষুদিরাম বসুর আদর্শ জ্বলন্ত প্রদীপের মত বয়ে নিয়ে চলা বীরেন্দ্র যখন স্বাধীন ভারতকে অনুভব করলেন, তখন তাঁর বুক জুড়ে তীব্র, প্রচণ্ড স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। তাঁর কবিতায় সে বেদনা বারবার আছড়ে পড়েছে তীব্র ক্ষোভ, রাগ ও ব্যঙ্গে। ‘ভারতবর্ষ’ কবিতায় ১৯৪২ আর ১৯৬২-র প্রসঙ্গে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট। বীরেন্দ্র দেখেন এবং দেখান দেশ স্বাধীন, কিন্তু নিরন্ন। দেশ স্বাধীন, কিন্তু অশ্রুজর্জর। এই স্বাধীনতার প্রতি তাঁর সুগভীর ধিক্কার জানিয়েছেন – ‘স্বাধীনতা প্রাণহীন একটি ধাতব শব্দ’ বলে। নতুন ভোরের জন্য আজীবন অপেক্ষা করেছেন। মানুষ বিশ্বাস রেখেছেন গভীরভাবে। স্বাধীনতার স্বেচ্ছাচারী বিপন্নতাকে তীব্র শানিত পংক্তিতে উলঙ্গ করেছেন তিনি। অন্যান্য কবিদের মত একে গণতন্ত্র বলে ন্যাকাকান্না কাঁদতে পারেননি। প্রেম তুচ্ছ হয়ে গেছে তাঁর কাছে। কারন শত শত বিরহগাথা অথবা সুগভীর তর্কে ব্যস্ত যৌবনযুগলের চেয়ে তাঁর কাছে অনেক বেশি তীব্র রাজনৈতিক দ্বিচারিতার অভিঘাত।
উঁচু মাথা নিয়ে বাঁচা কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনার অবসর আমাদের যত বেশি মেলে ততই সৌভাগ্য। কারন আজও সটান সোজা কথা বলার মত ভাষা চাই। ভীষণভাবে।
Session expired
Please log in again. The login page will open in a new tab. After logging in you can close it and return to this page.